আল্লাহ তাআলার নিআমত অপরিসীম। গুনে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন—

وَ اِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا  اِنَّ اللهَ لَغَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ.

তোমরা যদি আল্লাহর নিআমতসমূহ গুনতে শুরু কর, তবে তা গুনে শেষ করতে পারবে না। বস্তুত আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। —সূরা নাহল (১৬) : ১৮

বান্দার কর্তব্য হল, নিআমতের শোকর আদায় করা। মুখে এবং কাজের মাধ্যমে।

এই কর্তব্য পালন করলে দয়াময় আল্লাহ নিআমত আরও বাড়িয়ে দেবেন। আর কর্তব্যে অবহেলা করলে রয়েছে কঠিন শাস্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন—

لَىِٕنْ شَكَرْتُمْ لَاَزِيْدَنَّكُمْ وَ لَىِٕنْ كَفَرْتُمْ اِنَّ عَذَابِيْ لَشَدِيْدٌ.

যদি তোমরা শোকর কর তবে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বেশি দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি অবশ্যই কঠোর। —সূরা ইবরাহীম (১৪) : ০৭

আমাদের সন্তান-সন্ততিও এমন এক মহা নিআমত, যা শুধু সে-ই পায়, আল্লাহ যাকে দান করেন। এখানে কারও কোনোরূপ ক্ষমতা চলে না।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ   يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ يَهَبُ لِمَنْ يَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ يَهَبُ لِمَنْ يَّشَآءُ الذُّكُوْرَ،اَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا  وَ يَجْعَلُ مَنْ يَّشَآءُ عَقِيْمًا  اِنَّهٗ عَلِيْمٌ قَدِيْرٌ.

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। —সূরা শূরা (৪২) : ৪৯-৫০

অতএব সন্তান-সন্ততিকে মহান আল্লাহর বিশেষ নিআমত জ্ঞান করে শোকর আদায় করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এ সম্পর্কে কাল কিয়ামতে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

এক দীর্ঘ হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

পুরুষ তার পরিবারের যিম্মাদার; পরিবার সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানদের যিম্মাদার; তাদের সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৯২৮

আমাদের কর্তব্য

আমাদের কর্তব্য হল, সন্তানের দুনিয়াবি প্রয়োজনগুলো যথাসাধ্য পূরণ করা এবং সে যেন আখেরাতে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত লাভের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে পারে— এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِيْكُمْ نَارًا وَّ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ…

হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর…। —সূরা তাহরীম (৬৬) : ০৬

আমরা অনেকেই সন্তানের অস্থায়ী ভবিষ্যতের সফলতার জন্য তো নানান চেষ্টা ও তাদবীর করি; কিন্তু তার চিরস্থায়ী সফলতার ব্যাপারে উদাসীন থাকি।

জাহান্নাম থেকে রক্ষার উপায়

কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে রক্ষা এবং জান্নাত লাভের মৌলিক দুটি উপায় উল্লেখ করেছেন—

وَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓىِٕكَ اَصْحٰبُ الْجَنَّةِ  هُمْ فِيْهَا خٰلِدُوْنَ.

আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারা জান্নাতের অধিবাসী; তারা তাতে চিরকাল থাকবে। —সূরা বাকারা (২) : ৮২

এমন আরও অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলোর বার্তা হল— ‘জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ ও জান্নাত লাভের উপায় ঈমান ও নেক আমল।’

অতএব সন্তানকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করতে হলে, তাকে ঈমান ও নেক আমলের ধারক এবং কুফুর, শিরক ও মন্দ কাজ বর্জনকারী বানাতে হবে। এজন্য ছোট থেকেই তার পেছনে পরিকল্পিত মেহনত করতে হবে।

আমাদের করণীয়

এক. সন্তানের জন্য দুআ করা

সন্তানকে নেককার হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার সাথে সাথে দুআও করতে হবে— আল্লাহ তাআলা যেন তাকে নেককার বানান। এমন দুআ কুরআনে কারীমে অনেক রয়েছে। যেমন—

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّيّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْيُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ اِمَامًا.

হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির পক্ষ থেকে আমাদের দান করুন চোখের শীতলতা এবং আমাদের পরহেযগারদের জন্য আদর্শ বানান। —সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪

মারইয়াম আ.-এর মায়ের দুআ—

وَ اِنِّيْۤ اُعِيْذُهَا بِكَ وَ ذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطٰنِ الرَّجِيْمِ.

আমি তাকে (মারয়ামকে) ও তার সন্তান-সন্ততিকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয়ে দিচ্ছি। —সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩৬

যাকারিয়া আ.-এর দুআ—

قَالَ رَبِّ اِنِّيْ وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّيْ وَ اشْتَعَلَ الرَّاْسُ شَيْبًا وَّ لَمْ اَكُنْۢ بِدُعَآىِٕكَ رَبِّ شَقِيًّا، وَ اِنِّيْ خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَّرَآءِيْ وَ كَانَتِ امْرَاَتِيْ عَاقِرًا فَهَبْ لِيْ مِنْ لَّدُنْكَ وَلِيًّا، يَّرِثُنِيْ وَ يَرِثُ مِنْ اٰلِ يَعْقُوْبَ  وَ اجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا.

হে আমার রব! আমার অস্থিসমূহ দুর্বল হয়ে গেছে এবং মাথায় বার্ধক্যের শুভ্রতা ফুটে উঠেছে। আর হে রব! আপনার নিকট প্রার্থনা করে আমি কখনো বিফল হইনি।

আমি আমার পরে আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারে ভয় করি, আর আমার স্ত্রীও বন্ধ্যা, অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট থেকে দান করুন একজন কার্যনির্বাহক। যে (দ্বীন বিষয়ে) আমার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং ইয়াকুবের সন্তান-সন্ততির। আর হে রব! তাকে করুন পছন্দসই। —সূরা মরইয়াম (১৯) : ৪-৬

ইবরাহীম আ.এর দুআ

رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ.

অর্থাৎ হে আমার রব! আমাকে একজন সৎপুত্র দান করুন। —সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০০

رَبِّ اجْعَلْنِيْ مُقِيْمَ الصَّلٰوةِ وَ مِنْ ذُرِّيَّتِيْ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلْ دُعَآءِ.

অর্থাৎ হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানান এবং আমার সন্তান-সন্ততির মধ্য থেকেও (একদলকে)। হে আমাদের রব! আর আমাদের দুআ কবুল করুন। —সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪০

আম্বিয়ায়ে কেরাম জানতেন, আল্লাহর কাছে কী চাইতে হয়। কীভাবে চাইতে হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁদের দুআগুলো পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

দুই. নিজেদের পরিবেশ ও চালচলন ঠিক করা

শিশুরা পরিবারের সদস্যদের দেখে শেখে। এই শেখা শুরু হয় মুখ ফোটারও আগে। অনেক শিশু অন্যদের দেখাদেখি নামায পড়ে, হাত বাঁধে, রুকু-সিজদা করে। তাই শিশুর দ্বীনী তারবিয়াতের জন্য দ্বীনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

তিন. শিক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া

নিকট অতীতের বিখ্যাত আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রাহ. বলেন—

‘আম্বিয়ায়ে কেরামের দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি হল : এটি মূলত আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের প্রস্তুতির জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিক ও অপরিহার্য দাবি এই  যে, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাসআলা হল, আখেরাতে সফলতা অর্জন করা। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তার সন্তানের এই হক সাব্যস্ত করেছেন যে, একেবারে প্রথম থেকেই তার দ্বীনী তালীম ও তারবিয়াতের ফিকির করবে। এতে অবহেলা করলে গুনাহগার হবে।’ —মাআরিফুল হাদীস ৩/২৭৪

অতএব সন্তানকে প্রথমে আল্লাহর নাম ও কালিমা শেখাতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন যিকির, মাসূর দুআ এবং ইসলামী শিষ্টাচার শেখাতে হবে।

নবীজীর আমল দেখুন— ওমর ইবনে আবি সালামা রা. বলেন, আমি ছোট অবস্থায় নবীজীর কাছেই লালিত পালিত হয়েছি। একবার খাওয়ার সময় পাত্রের চতুর্পাশ থেকে খাচ্ছিলাম। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন—

يَا غُلَامُ، سَمِّ اللهَ، وَكُلْ بِيَمِينِكَ، وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ.

‘হে বৎস! বিসমিল্লাহ বল, ডান হাতে খাও এবং তোমার পাশ থেকে খাও।’ —সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০২২

এভাবে শিশুকে ছোট থেকেই হাতে-কলমে সুন্নত, আদব ইত্যাদি শেখানো।

চার. সন্তান যেন আমার থেকে কোনো মন্দ কাজ না শেখে

সতর্কতার অভাবে অনেক সময় শিশুরা আমাদের থেকেও বিভিন্ন মন্দ কাজ শেখে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা কাম্য। কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা যায়।

ক. অনেক সময় জ্বালাতন থেকে বাঁচার জন্য আমরা শিশুর হাতে ডিভাইস-স্মার্টফোন দিয়ে দেই। অথচ আমরা কি একটু চিন্তা করেছি! সামান্য সময়ের জ্বালাতন থেকে বাঁচার জন্য আদরের সন্তানের হাতে এমন একটি অগ্নিখণ্ড তুলে দিলাম, যার কারণে তার ঈমান, আমল, আখলাক এককথায় দুনিয়া ও আখেরাত কোনো কিছুই রেহাই পাবে না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!

বিষয়টি ব্যাপক হওয়ায় হয়তো আমাদের কাছে তেমন কিছু মনে হয় না। মনে করি, কী আর এমন হবে! কিন্তু একটু ভাবলে দেখা যাবে, সন্তানের বহু আচরণ আমাদের এই কর্মের ফল।

এর সুন্দর সমাধান হল, সন্তানকে সময় দেওয়া। তার আনন্দ-বিনোদনের উত্তম পথ খুঁজে বের করা।

খ. শিশুকে কখনো মিথ্যা আশ্বাস না দেই। একে তো তা কবীরা গুনাহ তারপর আবার এ থেকে বাচ্চাও শিখবে যে, প্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলা যায়। অতএব এক্ষেত্রেও সতর্কতা কাম্য। এ বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলেছেন শুনুন—

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. বলেন—

(ছোট বেলায়) একদিন (আমি খেলার জন্য ঘর থেকে বের হতে চাইলে) আম্মা ডাক দিয়ে বললেন, এদিকে আস, তোমাকে একটি জিনিস দেব। তখন নবীজী আমাদের ঘরে ছিলেন। তিনি বললেন, তুমি তাকে কী দিতে চেয়েছ?

মা বললেন, আমি তাকে খেজুর দিতে চেয়েছি।

তখন নবীজী বললেন, তুমি যদি তাকে কিছু না দাও তবে তোমার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার গুনাহ হবে। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৭০২

ঘ. রাগের সময় কোনো অসমীচীন শব্দ না বলি। কেউ কেউ এই সময় সন্তানকে গালিগালাজ করে। অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে; যা কোনো সভ্য মানুষ থেকেও কাম্য নয়। এতে অনেকগুলো ক্ষতি :

১. এটি কবীরা গুনাহ

২. এর কারণে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধাবোধ বাকি থাকে না।

৩. সন্তানও পিতা-মাতার উপর এগুলো প্রয়োগ করে।

এক নারীকে দেখেছি, সে তার ছেলেকে খুব গালিগালাজ করত। কিছুদিন পর দেখি, ছেলেও তার মাকে গালিগালাজ করছে এবং ঐ শব্দগুলোই বলছে, যেগুলো তার মা একসময় বলত।

এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা আমাদের আচরণ থেকে সন্তান শেখে। সুতরাং আমরা সন্তানের সাথে এমন আচরণ করব না, যা তার থেকে কামনা করি না।

পাঁচ. সন্তানের তারবিয়াতের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকা

সন্তানকে কোনো অন্যায় কাজ করতে দেখলে ছোট বলে এড়িয়ে না যাই; তার মতো করে তাকে শেখাই বা শাসন করি। মনে রাখতে হবে, আজকের শিক্ষাদান, একটু চোখ রাঙানো বা সামান্য ধমক দেওয়াতে যে কাজ হবে, হয়তো একসময় সর্বশক্তি ব্যয় করেও সেই কাজ হবে না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল দেখি। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন—

একবার নবীজীর নাতি হাসান ইবনে আলী রা. একটি সদকার খেজুর মুখে দিল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখে সাথে সাথে বললেন— কাখ্ কাখ্, ফেল ফেল, তুমি জানো না, আমরা (নবীবংশ) সদকার বস্তু খাই না! —সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৯১

হাসান রা.-এর জন্ম তৃতীয় হিজরীর রমযানে। সেই হিসেবে তখন তার বয়স আর কতইবা হবে। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট্ট শিশু বলে এড়িয়ে যাননি। একথা বলেননি— সে তো ছোট, সামান্য একটি খেজুরে কী-ই বা হবে; বরং বাধা দিয়েছেন, খেতে দেননি; উপরন্তু তারবিয়াতের জন্য একটু ধমকের স্বরে বলেছেন— তুমি জানো না, আমরা সদকা খাই না।

এই হল আমাদের নবীজীর শিক্ষা ও আদর্শ। কিন্তু আমরা অনেকসময় নিজেরাই অজুহাত পেশ করি—সে তো ছোট।

ছয়. সন্তানকে কমপক্ষে ফরযে আইন পরিমাণ দ্বীনী ইলম শেখানো

সন্তান একটু বড় হলে তাকে ধীরে ধীরে ওযু, গোসল, নামায, কুরআন কারীমের তিলাওয়াত ও আকায়েদ থেকে শুরু করে দ্বীনের মৌলিক বিধানগুলো শেখাতে হবে।

সাত. সন্তানকে নেক আমলে অভ্যস্ত করা

সন্তানকে নেক আমলে অভ্যস্ত করার জন্য আমাদের কয়েকটি কাজ করতে হবে :

ক. নিজেরা নেক আমলে পাবন্দ হতে হবে। কেননা শিশুরা বড়দের অনুকরণ করে।

খ. নামায, রোযা ও অন্যান্য আমলে সন্তানকেও নিজেদের সাথে শরীক করতে হবে। আসুন এ ব্যাপারে সাহাবা যুগের একটি আমল দেখি—

রুবাইয়ে রা. বলেন, একবার আশুরার দিন সকালে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পাশ্বর্বর্তী গ্রামগুলোতে সংবাদ পাঠালেন, ‘যারা রোযা রেখেছে তারা যেন পূর্ণ করে আর যারা রাখেনি তারা যেন অবশিষ্ট দিবস রোযাদারের মতো থাকে।’

এরপর থেকে আমরা নিজেরা (আশুরার) রোযা রাখতাম। আমাদের শিশুদেরকেও এতে অভ্যস্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত তাদেরকে নিয়ে মসজিদে থাকতাম। তাদের জন্য তুলার খেলনা বানিয়ে রাখতাম। খাবারের জন্য কেউ কান্না করলে সেই খেলনা দিতাম। —সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬

সাহাবীগণ তাদের শিশুদেরকে রোযার মতো একটি সুকঠিন আমলে কীভাবে অভ্যস্ত করতেন!

গ. বাচ্চাকে নেক আমলের আদেশ দিতে হবে। এই ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করে বলেন—

وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَيْهَا  لَا نَسْـَٔلُكَ رِزْقًا  نَحْنُ نَرْزُقُكَ  وَ الْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰي.

আর আপনি স্বীয় পরিবার-পরিজনকে নামাযের আদেশ করুন এবং নিজেও তাতে অবিচল থাকুন। আমি আপনার নিকট রিযিক চাই না, আমিই আপনাকে রিযিক দান করি। আর শুভ পরিণাম তাকওয়া (অবলম্বনকারীদের) জন্য। —সূরা ত্ব-হা (২০) : ১৩২

সন্তান যদি কথা না শোনে তাহলে প্রয়োজনে কিছু শাসনও  করতে হবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

তোমাদের বাচ্চাদের সাত বছর পূর্ণ হলে (তাদেরকে) নামাযের তাকীদ কর। আর দশ বছর পূর্ণ হলে নামাযে অলসতার কারণে প্রহার কর এবং এ বয়সে উপনীত হলে বিছানা পৃথক করে দাও। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫

দশ বছর বয়সে নামায ফরয হয় না তবুও প্রহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে সে বালেগ হওয়ার আগেই নামাযে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এই হাদীসে অন্যান্য আমলের উল্লেখ না থাকলেও সেগুলোর বিধান নামাযেরই মতো।

আট. শিশুর অন্তরে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আখেরাতমুখী চিন্তাচেতনার বীজ বপন করা

এ উদ্দেশ্যে আমাদের কয়েকটি কাজ করতে হবে :

ক. বাচ্চাকে এই বিষয়ে তার মতো করে নসীহত করতে হবে। এই বিষয়ে অনুসরণীয় হল, লুকমান আ.-কতৃর্ক স্বীয় পুত্রকে নসীহত। যা কুরআন কারীমের সূরা লুকমানের ১৩, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ মোট পাঁচটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তেমনি ইবরাহীম আ. ও ইয়াকুব আ.-কতৃর্ক নিজ সন্তানদেরকে উপদেশ। যা সূরা বাকারার ১৩২ ও ১৩৩ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

খ. নবীদের কাহিনী, আমাদের নবীজীর সীরাত ও সাহাবা-তাবেয়ীন এবং আকাবির-আসলাফের জীবনী ও ঘটনাবলি শোনানো।

গ. উলামায়ে কেরামের মজলিসে নিয়ে যাওয়া। কারণ ওলামায়ে কেরাম হলেন এই গুণের ধারক বাহক।

এপর্যায়ে দুজন কর্তব্যপরায়ণ অভিভাবকের গল্প শুনি, তাদেরই সন্তানদের মুখে।

এক. হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রাহ.-এর পিতা আবদুল হক রাহ.।

থানবী রাহ. বলতেন, ‘আমার পিতা যে সুব্যবস্থাপনায় আমাদের (দুই ভাইয়ের) তারবিয়াত করেছেন তা তাঁর গভীর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির পরিচায়ক ছিল।

লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে বলতেন, চার-পাঁচ বছর বয়সে মায়ের ইন্তেকালের পর পিতা অত্যন্ত স্নেহ-মমতার সাথে আমাদের দুই ভাইকে প্রতিপালন করেছেন। মাতৃ-বিয়োগের শোকও তিনি আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। তারাবীর নামায শেষে খতমের যে মিষ্টি মসজিদসমূহে বিতরণ করা হত তা আমাদের কখনো গ্রহণ করতে দিতেন না। বরং সেদিন দোকান থেকে মিষ্টি খরিদ করে এনে আরও বেশি করে খাওয়াতেন এবং বলতেন, ‘মসজিদে মিষ্টি আনতে যাওয়া আমাদের জন্য লজ্জাকর।’ এভাবে তিনি আমাদের লোভ-লালসা থেকে বাঁচাতেন এবং লজ্জা শেখাতেন।

একদা ছাত্রজীবনে দেওবন্দ মাদরাসার প্রাক্তন মুহতামিম হযরত মাওলানা রফী উদ্দীন সাহেব রাহ. সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, ‘মাওলানা সাহেব রাহ. লেখাপড়া বেশি করেননি। কিন্তু মাদরাসা পরিচালনার কাজে খুবই দক্ষ ও কামিল বুযুর্গ ছিলেন।

একথা শুনে আব্বা রাগান্বিত হলেন এবং ধমক দিয়ে বললেন, ‘বুযুর্গদের শানে এ রকম উক্তি করতে নেই।’ তিনি রাগে আমাকে মারতে উঠলেন, তবে মারেননি।

মোটকথা, আমাদের আখলাকের প্রতি তিনি খুবই লক্ষ্য রাখতেন, কিন্তু সেইসঙ্গে যারপরনাই স্নেহ-মমতা ও আদর-ভালবাসা দিতেন।’ —আশরাফ চরিত ৪৫, ৪৮-৪৯

দুই. বিখ্যাত দাঈ, মুফাক্কিরে ইসলাম, আরব-আজমের শায়েখ, বহু কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর আম্মা। আলী মিয়া রাহ. যেহেতু বাল্যকালেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে যান, তাই মায়ের হাতেই তাঁর লালন-পালন ও তালীম-তরবিয়ত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

আমাকে এমনিতে অনেক স্নেহ করতেন। আব্বাজানের মৃত্যুর পর তাঁর স্নেহ আরও বেড়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তিনি দুটি বিষয়ে খুবই কঠোর ছিলেন।

এক. নামাযের ব্যাপারে কোনোরূপ ছাড় দিতেন না।

দুই. আমার দ্বারা কোনো কাজের বুয়ার ছেলে বা গরীব ছেলের সাথে বাড়াবাড়ি, অন্যায় বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ আরচণ হলে শুধু ক্ষমা চাওয়া নয়; বরং হাতজোড় পর্যন্ত করাতেন। এতে আমার যতই অপমান হত, তিনি কোনোভাবেই মানতেন না। এর দ্বারা জীবনে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি। জুলুম ও অহঙ্কারকে ভয় পেতে শিখেছি। কারও মনে কষ্ট দেওয়া বা কাউকে অপদস্থ করা কবীরা গুনাহ মনে করতে শিখেছি। এরই কারণে সারা জীবন নিজের ভুল স্বীকার করা আমার কাছে সহজ মনে হয়েছে। —যিকরে খায়ের, পৃ. ৪৭-৪৮

এটি শুধু তাদের দুজনের নয়, বরং যুগ যুগ ধরে সকল আদর্শ মা-বাবার সন্তান প্রতিপালনের পদ্ধতি। একদিকে যারপরনাই আদর-সোহাগ, অপরদিকে যথাযথ তালীম-তারবিয়াত।

এভাবেই তারা সন্তানদেরকে যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত করেছেন। মুসলিম উম্মাহকে উপহার দিয়েছেন হাকীমুল উম্মত ও আলী মিয়ার মতো নক্ষত্র, যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত ঝলমল করতে থাকবে এবং দিশা পেতে থাকবে অসংখ্য অগণিত পথিক। আর নিজেরা ইনশাআল্লাহ অধিকারী হবেন সেই জ্যোতির্ময় মুকুটের, যার সুসংবাদ দিয়েছেন মহানবী সা. তাঁর এই বাণীতে :

যে ব্যক্তি কুরআন কারীম পড়বে এবং তার নির্দেশ মতো আমল করবে কিয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি হবে (যদি সূর্য তোমাদের ঘরে হত) তাহলে যে স্বয়ং আমল করবে তার ব্যাপারে তোমাদের কী ধারণা। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫৩

আমরাও তাদের কাফেলায় শামিল হওয়ার চেষ্টা করি। নিজ নিজ সন্তানের পেছনে মেহনত করি। তাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করি  শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে। আল্লাহর রহমত তো আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। চিরকাল তেমনই থাকবে। প্রয়োজন শুধু একটু বোধ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Select the fields to be shown. Others will be hidden. Drag and drop to rearrange the order.
  • Image
  • SKU
  • Rating
  • Price
  • Stock
  • Availability
  • Add to cart
  • Description
  • Content
  • Weight
  • Dimensions
  • Additional information
Click outside to hide the comparison bar
Compare